একজন মানুষের মানবাধিকার হলো সেই অধিকার, যা নিয়ে মানুষ জম্মায়। অর্থাৎ একজন মানবসন্তান জন্মলগ্ন থেকে কিছু অধিকার প্রাকৃতিকভাবেই প্রাপ্ত। যেমন—তার বেঁচে থাকা বা জীবনধারণের অধিকার, বেড়ে ওঠার জন্য খাদ্য ও চিকিৎসাসেবা পাওয়ার অধিকার ইত্যাদি। রাষ্ট্র ও সমাজ তার এসব অধিকার মেনে নিতে বাধ্য।
এসব অধিকারহরণ করলে একজন ব্যক্তি সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে সমাজে জীবন যাপন করতে পারে না। মানুষ হিসেবে তার গর্ব, আত্মসম্মানবোধ ও মানসিক প্রশান্তি থাকে না। উদাহরণ দিয়ে বলা যায়, একজন মানুষ জন্মসূত্রেই পায় নিজের স্বাধীন চিন্তাশক্তি, মত প্রকাশ ও কথা বলার অধিকার ও মানবাধিকার। কিন্তু রাষ্ট্রের একজন নাগরিক এসব অধিকার থেকে বঞ্চিত হলে তাকে তার মানবিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়।
তখন তার মধ্যে ক্ষোভ ও প্রতিবাদস্পৃহা সৃষ্টি হয়।
মানুষের মৌলিক অধিকার হলো সেই সব অধিকার, যা বেঁচে থাকার জন্য অপরিহার্য, যেমন—খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বিনোদন। বেঁচে থাকার জন্য একজন নাগরিকের এই ছয়টি অধিকার মৌলিক অধিকারের মধ্যে পড়ে। এগুলোর অভাবে একজন মানুষ স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকতে পারে না।
সব মৌলিক অধিকারই মানবাধিকার, কিন্তু সব মানবাধিকার মৌলিক অধিকার নয়। কোনো দেশের সংবিধান যে অধিকারগুলো মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেয় কেবল সেই মানবাধিকারগুলো নাগরিকদের মৌলিক অধিকার হিসেবে পরিগণিত হয়। বাংলাদেশের সংবিধানে নাগরিকদের মৌলিক অধিকারগুলো ২৬ থেকে ৪৪ আর্টিকলে বর্ণিত আছে। এসব অধিকারের মধ্যে আছে আইনের দৃষ্টিতে সমতা, আইনের আশ্রয়লাভের অধিকার, জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকার, গ্রেপ্তার ও আটক সম্পর্কে রক্ষাকবচ, চলাফেরার স্বাধীনতা, সমাবেশের স্বাধীনতা, সংগঠনের স্বাধীনতা, চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাকস্বাধীনতা, পেশা ও বৃত্তির স্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা, সম্পত্তির অধিকার, সংবাদ প্রচারের স্বাধীনতা ইত্যাদি।
১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর জাতিসংঘ সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা করে।
ঘোষণায় মানুষের ২৫টি মানবাধিকারকে জাতিসংঘ স্বীকৃতি দেয়। বিভিন্ন দেশ এই ২৫টি মানবাধিকারের মধ্যে যে কয়টি জাতীয় সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করেছে সেগুলোই ওই দেশের নাগরিকদের মৌলিক অধিকার।
মানবাধিকারের অতীত ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, দেশে দেশে বহু আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে ধীরে ধীরে মানুষ মানবাধিকার অর্জন করেছে। ১২১৫ সালে ইংল্যান্ডে ম্যাগনাকার্টা সনদ প্রণয়ন গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের একটি মাইলফলক। এই সনদ জনগণের আন্দোলনে তত্কালীন রাজা স্বাক্ষর করতে বাধ্য হন। ম্যাগনাকার্টা সনদ রাজার স্বেচ্ছাচারিতা ও স্বৈরতন্ত্রের অবসান ঘটায়। দেশ পরিচালনায় জনগণের প্রতিনিধিদের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হয়।
ইংল্যান্ডে পিটিশন অব রাইটস এবং বিল অব রাইটসেও কর আরোপ, সামরিক শাসন জারি ও বিনা কারণে গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে রাজার ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করা হয়। পার্লামেন্টের অনুমোদন ছাড়া রাজা এসব ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবেন না। বিল অব রাইটস ১৬৮৮-এর মাধ্যমে নাগরিকদের কিছু সিভিল রাইটস আইনগত রক্ষাকবচ প্রতিষ্ঠা করা হয়। আমেরিকাতে বিল অব রাইটস ১৭৮৭ পাস করে নাগরিকদের কতগুলো মৌলিক অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
ফ্রান্সের ন্যাশনাল কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলি ১৯৮৯ কর্তৃক পাস করা দ্য ডিক্লারেশন অব দ্য রাইটস অব ম্যান অ্যান্ড অব দ্য সিটিজেন ফ্রান্স বিপ্লবের চেতনার আলোকে নাগরিকদের ব্যক্তিস্বাধীনতা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আরেকটি মাইলফলক।
উল্লেখিত সনদসমূহ ও আরো অনেক বিধি-বিধান এবং জাতিসংঘের গৃহীত বিভিন্ন রেজল্যুশন মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে। এসব সনদের আলোকেই দেশে দেশে নাগরিকদের মানবাধিকার ও মৌলিক অধিকার আইনগত স্বীকৃতি পেয়েছে।
মানবাধিকার ও মৌলিক অধিকার আইনগতভাবে স্বীকৃতি পেলেই যে নাগরিকরা মানবাধিকার ও মৌলিক অধিকার ভোগ করতে পারবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। গণতান্ত্রিক পরিবেশ এবং জাতীয় সরকারের সদিচ্ছা ছাড়া নাগরিকরা মানবাধিকার ও মৌলিক অধিকার ভোগ করতে পারে না। প্রকৃত গণতন্ত্র, গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো, গণতন্ত্রের চর্চা ও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি হলো মানবাধিকার ও সাংবিধানিক অধিকার ভোগের পূর্বশর্ত। গণতন্ত্রের অনুপস্থিতিতে নাগরিকদের মানবাধিকারকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। একজন নাগরিক মানুষ হিসেবে সমাজে মর্যাদা পায় না। তাই মানবাধিকারের মতো গণতন্ত্রের ধারণাটিও মানুষ প্রাচীন আমল থেকেই পোষণ করছিল। দার্শনিক রুশো, কার্ল মার্ক্স প্রমুখ মনীষীর লেখায়ও মানবাধিকারের বিষয়টি প্রতিফলিত হয়েছে। ধীরে ধীরে মানুষও অনেক অধিকারসচেতন হতে শুরু করে। তাই রাষ্ট্রনায়কগণ রাষ্ট্রচিন্তায় মানবাধিকারকে তুচ্ছজ্ঞান করতে পারেননি। তাঁরা জাতিসংঘ ঘোষিত সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্র নিজ দেশে বলবৎ করার জন্য সম্মতিপত্রে স্বাক্ষর করেছেন এবং তাঁদের জাতীয় সংবিধানে মানবাধিকারকে স্বীকৃতি দিয়েছেন।
প্রকৃত গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় দেশের অভ্যন্তরে সব গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় প্রতিষ্ঠিত হয় এবং সেখানে গণতন্ত্রের চর্চা হয়। প্রতিষ্ঠানগুলো বাইরের হস্তক্ষেপ ছাড়াই নাগরিকদের মানবাধিকার, মৌলিক অধিকার ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে সমুন্নত রাখার জন্য কাজ করতে পারে। কিন্তু বাইরের অযাচিত হস্তক্ষেপ থাকলে তা সম্ভব হয় না। এ ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ভূলুণ্ঠিত হয়।
গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটলের মতে, গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় জনগণের মতামতের প্রতিফলন হয়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন তাঁর ঐতিহাসিক গেটিসবার্গ বক্তৃতায় বলেছিলেন,
‘Government of the people, by the people, for the people shall not perish from the earth. তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন—জনগণের জন্য, জনগণের সরকার, জনগণ দ্বারা নির্বাচিত হলে সেই গণতান্ত্রিক সরকার পৃথিবীতে টিকে থাকবে। পরবর্তীকালে তাঁর এই কথার সত্যতা আমরা দেখতে পাই। যে দেশে গণতন্ত্র আছে, সেই দেশে গণতান্ত্রিক সরকার থাকে এবং তার ধারাবাহিকতাও থাকে। আমরা যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, ইউরোপের অন্যান্য দেশ, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ইত্যাদি দেশের দিকে তাকালে এর বাস্তবতা দেখতে পাই। ওই সব দেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়।
গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় জনগণের সম্পৃক্ততা থাকায় তা শক্তিশালী হয়। এ ব্যবস্থায় কোনো একক ব্যক্তির খেয়ালখুশিমতো সরকার চলে না। জনগণ দ্বারা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সম্মিলিত মতামতের ভিত্তিতে সরকার দেশ পরিচালনা করে বিধায় সরকারের প্রতি জনসমর্থন থাকে। জনপ্রতিনিধিরা জনগণের কাছে জবাবদিহি করে থাকে। সরকারের সার্বিক পারফরম্যান্সে জনগণ সন্তুষ্ট না থাকলে পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনে জনগণ নতুন লোকের পক্ষে ম্যান্ডেট দেয়। এ কারণে প্রকৃত গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা টেকসই হয়।
আবার গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচিত জনগণের সরকার নতুন কৌশলে স্বৈরাচারী আচরণ করে, এমন উদাহরণও পৃথিবীতে অনেক আছে। সরকার নানা কৌশলে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নিজ দেশের নাগরিকদের মানবাধিকার, মৌলিক অধিকার ও গণতান্ত্রিক অধিকারকে লঙ্ঘনও করে থাকে। মিয়ানমার সরকারের সামরিক বাহিনী দ্বারা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর অত্যাচার, নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে ১১ লাখ নারী-পুরুষ ও শিশুকে দেশ থেকে বিতাড়িত করেছে। বংলাদেশ সরকার মানবিক কারণে তাদের আশ্রয় দিয়েছে। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৮তম অধিবেশনে রাষ্ট্র কর্তৃক নাগরিকদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। বিশেষ করে সিরিয়ায় নাগরিকদের মানবাধিকার লঙ্ঘন, মিয়ানমারে গণহত্যা, ইরাক, চীন ও ইউক্রেনের ব্যাপারে উদ্বেগটা বেশি ছিল। সংঘাতপূর্ণ এলাকায় বেসামরিক নাগরিকদের নিরাপত্তা ও মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। সুদান ও চীনের উইঘুরের জনগণের মানবাধিকারের বিষয়টি আলোচনায় আসে। আফগানিস্তানসহ কোনো কোনো মুসলিম দেশে নারীদের মানবাধিকার ও মৌলিক অধিকার ভোগের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। সম্প্রতি অর্থাৎ ২০২৩ সালের ৭ অক্টেবরের পর হামাসের আক্রমণের জবাব দিতে গিয়ে ইসরায়েল গাজার বেসামরিক ও নিরস্ত্র জনগণের ওপর বিমান দিয়ে বোমা হামলা করে হাজার হাজার লোককে হত্যা করছে। ঘরবাড়ি, দালানকোঠা, হাসপাতাল, উপাসনালয় ইত্যাদি গুঁড়িয়ে দিচ্ছে। এ পর্যন্ত ২৪ হাজারের বেশি বেসামরিক লোক নিহত হয়েছে। তাদের মধ্যে শিশু, বৃদ্ধ ও নারী রয়েছে। ইসরায়েলের এই গণহত্যা স্মরণকালের মানবাধিকার লঙ্ঘনের রেকর্ডকে হার মানিয়েছে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে বৃহৎ শক্তিধর আমেরিকা, ব্রিটেনসহ অনেক দেশ ইসরায়েলকে সমর্থন ও সহায়তা করছে। মুসলিম বিশ্বসহ অনেক দেশ নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে।
মানবাধিকার ও গণতন্ত্র তখনই সুরক্ষিত হবে, যখন জনগণ এ বিষয়ে সচেতন হবে এবং তা আদায়ের জন্য সোচ্চার হবে। রাজনীতিবিদ ও রাষ্ট্র পরিচালনায় যাঁরা থাকবেন তাঁরা যদি মনেপ্রাণে মানবাধিকার ও গণতন্ত্রকে বিশ্বাস করেন এবং হৃদয়ে ধারণ করেন তাহলেই একটি দেশে গণতন্ত্র ও নাগরিকদের মানবাধিকার সুরক্ষিত থাকে। গণতন্ত্রকে শুধু স্লোগানের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে সংশ্লিষ্ট সব মহলের ব্যক্তিজীবন, সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান এবং সমাজের সব স্তরে গণতন্ত্রের চর্চার মাধ্যমে প্রকৃত গণতন্ত্র ও মানবাধিকারকে রাষ্টীয় ও সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
সম্পাদনায়
এডভোকেট মোঃ আনোয়ার হোসেন ভুঁঞা
লিখক ও গবেষক
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন (ILSR)
মঙ্গলায়তন ইউনিভার্সিটি,ইউপি,আলীগড়,ইন্ডিয়া
Email-20221326_anower@mangalayatan.edu.in